
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা)
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভূমিকা অপ্রতুল


স্রেডার সক্ষমতাকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। এই প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্রীভূত করে রাখা হয়েছে। অথচ নবায়নযোগ্য জ্বালানির স্বার্থে স্রেডাকে বিকেন্দ্রীকরণের কোনো বিকল্প নেই।
-তানজিমউদ্দিন
বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো যখন শূন্য কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্যে নিচ্ছে নানা ধরনের পদক্ষেপ সেখানে জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রার কতখানি অর্জন করলো সেটি অনেকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। উৎপাদন সক্ষমতার এই বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের উৎস কয়লা এবং জ্বালানি তেল, যেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভূমিকা অপ্রতুল। বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা ২০০৮ এ নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের মধ্যে ৫ শতাংশ এবং ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ জ্বালানির চাহিদা পূরণ হবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। তবে লক্ষ্যমাত্রা যাই থাকুক না কেন জাতীয় গ্রেডে দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান এখন পর্যন্ত দুই শতাংশের নিচে।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, দেশে যে পরিমাণে জ্বালানি ব্যবহার করা হয় তারমধ্যে নবায়নযোগ্য ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। প্যারিসচুক্তির ন্যাশনালি ডিটারমিনেন্ট কন্ট্রিবিউটর (এনডিসি) অনুযায়ী, বাংলাদেশের ২০৪০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান জাতীয় গ্রিডে ৪০ শতাংশ হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ বর্তমানে এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে যেখানে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন এক রকমের অলীক স্বপ্ন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এর আগে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ বাড়াতে চালু করা হয় নেট মিটারিং ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় নতুন বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে ভবনের ছাদে এক হাজার বর্গফুট জায়গা থাকলেই গ্রাহককে নেট মিটারিংয়ের আওতায় সৌর প্যানেল স্থাপন করতে হবে। শিল্প গ্রাহক, আবাসিক গ্রাহক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল কিংবা দাতব্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানে নেট মিটারিং এর ব্যবস্থা থাকলেও সেখান থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো বিদ্যুৎ না গ্রাহক পাচ্ছে, না যোগ হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্বলানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তানজিমউদ্দিন খান সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেন, ডেসকো ঢাকাতে এখন পর্যন্ত ৩৪ হাজার রুফটপ সোলার প্যানেল বসিয়েছে, যার মধ্যে বর্তমানে কার্যকর আছে ৪ হাজারের মতো সোলার প্যানেল। অন্যদিকে বিপিডিসি সোলার প্যানেল বসিয়েছে ৪৭ হাজার এবং কার্যকর আছে ১৯ হাজার। দেদারসে সোলার প্যানেল বসালেই হবে না, এটি আদৌ কার্যকর আছে কিনা, গ্রাহক সুবিধাভোগী হতে পারছে কিনা এসব বিষয়েও নজর দিতে হবে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার (ইপিজেড) ৩০ শতাংশ জায়গা ব্যবহার করলে ৩৩৩ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। বিগত বছরগুলোতে নেট মিটারিং এর আওতায় যত বিদ্যুৎ এসেছে তার ৫৫ শতাংশের যোগানদাতা বাণিজ্যিক ভবন। এসব ভবন থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ এসেছে তা ৫০ শতাংশের বেশি না।
এ ব্যাপারে ক্যাবের প্রস্তাবিত জ্বালানি রূপান্তর নীতি ২০২৪ এ বলা হয়েছে, জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক গ্রিড বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতোই সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনেও প্রতিযোগিতাবিহীন একপাক্ষিক বিনিয়োগ হচ্ছে। এতে করে বর্তমানে উৎপাদিত বিদ্যুতের মতো সৌরবিদ্যুতের ব্যয়ও অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক মুনাফা কেন্দ্রিক হবে বলে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ক্যাবের হিসাবে বলা হয়েছে, প্রতি ইউনিট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ১৫ দশমিক ৭ টাকা করে খরচ হচ্ছে, যা ভারতে ২ দশমিক ৬০ রুপি। জমির দামের দোহাই দিয়ে বিদ্যুতের দাম যেভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে তা যুক্তিসঙ্গত নয় বলে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময় সংবাদকে জানান, এখন পর্যন্ত বড় তিনটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র বড় তিনটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ২০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পাবনার হেমায়েতপুরের ১০০ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও লালমনিরহাট কালিগঞ্জে ৩০ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) প্রসঙ্গে তানজিমউদ্দিন বলেন, স্রেডার সক্ষমতাকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। এই প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্রীভূত করে রাখা হয়েছে। অথচ নবায়নযোগ্য জ্বালানির স্বার্থে স্রেডাকে বিকেন্দ্রীকরণের কোনো বিকল্প নেই। স্রেডার নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে এ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, এখানে মূলত যারা সরকারের বিরাগভাজন তাদের পদায়ন করা হয়। যে প্রতিষ্ঠানটি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে সেখানের নিয়োগ এবং পদায়ন প্রক্রিয়া যদি এমন হয় তাহলে এখান থেকে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আশা করা বোকামি।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এবং বিনিয়োগকারীদেরকে সরকার বিভিন্ন প্রকার প্রণোদনা প্রদান করছে। সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, ইডকল এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে। তাছাড়া কিছু নবায়নযোগ্য জ্বালানি পণ্য সোলার প্যানেল, সোলার প্যানেল প্রস্তুতের উপাদান, চার্জ কন্ট্রোলার, ইনভার্টার, এলইডি লাইট, সৌরচালিত বাতি এবং বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র এর উপর সরকার শুল্ক অব্যাহতিমূলক প্রণোদনা প্রদান করেছে বলে জানায় বিদ্যুৎ বিভাগ। শুধু প্রণোদনা ও শুল্ক ছাড় দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যাবে না। এজন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থা ও নীতিমালার প্রয়োজন। আর না হলে জীবাশ্ম জ্বালানির মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানিও একচেটিয়া দখলদারিত্বের সম্পত্তিতে পরিণত হবে বলে শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ